রংপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ। সুপ্রাচীনকাল থেকে এই জেলা গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসের অধিকারী। এর প্রায় ৮০ শতাংশ তিস্তার প্লাবন ভূমি এবং ২০ শতাংশ বরেন্দ্র ভূমির অন্তর্গত। এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, যমুনা, ধরলা প্রভৃতি নদ-নদী। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী ভারতের পূর্বাংশ কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যার অন্তর্গত ছিল বর্তমান রংপুর তথা রঙ্গপুর অঞ্চল। রাজা ভগদত্তের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ১৫শ' অব্দ) রংপুর প্রাগজ্যোতিষের অন্তর্গত ছিল। আবার রাজা সমুদ্র গুপ্তের সময় (৩৪০ খ্রি.) কামরূপের করদ রাজ্যে পরিগণিত হয়। পরবর্তীতে আবার এই অঞ্চল কোচবিহারের কিছু অংশ হিসেবে পরিচালিত হতো। ৪র্থ শতাব্দীর মধ্য থেকে এ অঞ্চল সর্বপ্রথম বর্মা রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত হয়। কালক্রমে পালবংশ, সেনবংশ আরও অনেক রাজবংশ এখানে রাজত্ব করে।
আইন-ই-আকবরীর বিবরণ অনুযায়ী মোঘল রংপুর ৩ ধরনের প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে ঘোড়াঘাটে মোগলদের একটি ফৌজদারী হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। একই স্থানে কাকিনা, কাজিরহাট, ফতেহপুর মোগলদের অধীনে আসে এবং ২৪ বছর পর ১৭১১ খ্রি. সমগ্র রংপুরে মোগল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর তিন দশকের শুরুতে মাহিগঞ্জে পর্যন্ত মোগল ইতিহাসের আর তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী লাভের পর রংপুর নতুন ব্যবস্থায় ইংরেজ শাসনাধীন আসে। রংপুর অঞ্চলে সর্বপ্রথম ১৭৬৫ সালে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে বিদ্রোহী সিপাহীরা। এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসকদের মাঝে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বপ্রথম কংগ্রেসের ডাকে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর এখানে উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং নভেম্বরে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়।
নামকরণের ইতিহাস : রংপুরের রঙ্গপুর নামকরণের কারণ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন মহাভারতের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রঙ মহল ছিল রংপুরে এবং সেই রঙমহল হতে নাম হয়েছে রঙ্গপুর। কারো কারো মতে ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে নারী জাগরণের অগ্রদ্রুত বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা ছিল। পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রং করা হতো বলে রংপুরকে রংরেজপুর বলা হতো এবং তার পরিবর্তে হয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। রঙ্গপুর শব্দটি ফার্সিশব্দ। আর তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসন আমলেই রংপুরের নাম রঙ্গপুর হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান : রংপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে ঐতিহ্যবাহী জনপদ। রংপুর জেলার উত্তরে লালমনিরহাট, পূর্বে কুড়িগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বে গাইবান্ধা, উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। তিস্তা নদীর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে পৃথক করেছে। রংপুর জেলার মোট আয়তন ২৩৬৭.৮৪ বর্গকিলোমিটার। ৮টি উপজেলা, ৭৬টি ইউনিয়ন, ৩টি পৌরসভা ও ১২১৪টি মৌজা নিয়ে জেলাটি গঠিত।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলী : ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরকে সেনাপতি মানসিংহ রংপুরের অংশ বিশেষ দখল করেন। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে রংপুর সম্পূর্ণভাবে মোঘল সম্রাজ্যভুক্ত হয়। আজও এ অঞ্চলে মোগল শাসনের স্মৃতি বহন করছে কুড়িগ্রামের মোগলবাসা ও মোগলহাট। মোগল আমলে রংপুর ছিল ঘোড়াঘাট সরকারের অন্তর্ভুক্ত।‘বিয়াজুস সালাতীন' নামক ইতিহাস গ্রন্থে রঙপুর ঘোড়াঘাটের নাম পাওয়া যায়। কোম্পানি আমলে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন ও প্রজা বিদ্রোহ এখানকার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ : স্বাধীনতাকামী রংপুরের মানুষ প্রথম যুদ্ধ শুরু করে ৩ মার্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ রংপুরের শংকু সমজদার। ৩ মার্চ ৩ জনের প্রাণদানের মাধ্যমে শুরু হয় রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ৩ মার্চ থেকে ৫ মার্চ রংপুরে কারফিউ চলে। এ অঞ্চলের মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ করে ২৪ মার্চ। ২৮ মার্চ রোববার রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিল এক নবচেতনায়। এদিন মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা বিক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ জনগণের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। করেছে নির্মমভাবে অত্যাচার। রংপুর অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়ে সৃষ্টি করে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
গণকবর : দমদমা ব্রিজ, দমদমা বাজার (মিঠাপুকুর উপজেলা), আংরাজ ব্রিজ, মাদারগঞ্জ বাজার (পীরগঞ্জ উপজেলা)।
খনিজ সম্পদ : যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। সে হিসেবে রংপুর জেলায় তেমন উল্লেখযোগ্য খনিজ সম্পদ না থাকলেও পীরগঞ্জের খালাশপীরে কয়লা এবং মিঠাপুকুরের রানীপুকুরে তামার সন্ধান পাওয়া গেছে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি : রংপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাহিত্যকর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন ও বিভাসিত। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের লীলানিকেতন এই রংপুর। বলা যায়, প্রকৃতির রহস্যময়তায় নান্দনিক সৌন্দর্যে প্রকৃতির আদরনীয় হিল্লোলে ও প্রাণময়তায় ভরপুর রংপুর। অর্থাৎ ‘রঙ্গরসে ভরপুর এই রঙ্গপুর'। এই রঙ্গরস শিক্ষা-সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি মিলিয়ে অনবদ্য। রঙ্গপুরের পরিবর্তিত রূপ রংপুর। বাংলাদেশের প্রাচীনতম অংশের নাম বন্দ্রে বা বরেন্দ্র। রংপুর সমতল বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত। পরবর্তী সময়ে যে অঞ্চল গৌড় অঞ্চল বলে পরিচিতি লাভ করে।
প্রাচীন নিদর্শনাবলী ও দর্শনীয় স্থান : কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ভবন, পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার বাড়ি, মন্থনার জমিদার বাড়ি, কেরামতিয়া মসজিদ, রংপুর যাদুঘর, মাওলানা কারামাত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর মাজার, হযরত শাহজালাল বোখারীর মাজার, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কুতুব শাহের মাজার, রায়পুর জমিদারবাড়ি, পাটগ্রামে রাজা নীলাম্বরের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, চন্দনহাট হরি মন্দির, ডিমলা রাজ কালী মন্দির ও মিঠাপুকুর যা মোগল আমলে খনন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস