Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১. পটভূমিঃ

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এ্যাক্টে ভারতবর্ষের দুটি প্রধান মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ১২ আগস্ট প্রকাশিত র্যাডক্লিপ রোয়েদাদে পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গেঁর মধ্যে সীমানা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। পূর্ব বাংলা হয় পাকিস্তানের অংশ-পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব থেকে জনগণ আশা করেছিলেন, এবার তাঁদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ হবে। তাঁদের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। উন্নত জীবনের অধিকারী হবেন। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অনুভব করলেন, তাদের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের শাসকবর্গ বহুবাচনিক সমাজে পূর্ব পরিকল্পিত ঐক্যবদ্ধ একক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এভাবে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি তৈরি হয়। ১৯৫২ সালে নিজস্ব ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দান করতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র জনতার। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালীর স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা ম্যান্ডেট নিয়ে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তার উত্তরণ ঘটে। জনগণ প্রত্যাশা  করেছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাসের গতি পাল্টাবেন। পাকিস্তানের শাসকবর্গ-কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সামরিক কর্মকর্তা-ষড়যন্ত্রের গ্রন্থিগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যেন শাসন ক্ষমতা কোনক্রমে বাঙ্গালীর হস্তগত না হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তা সঠিকভাবে অনুধাবন করেন।

২. ভাষা আন্দোলনঃ

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। পাকিস্তান সরকার এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ১৯৪৮ সালেই উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ চলতে থাকে যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৫২ সালে এবং সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জববারসহ আরো অনেকে শহীদ হয়। এই ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ১৯৫৬ সালে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে বাংলাকে উর্দূর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৩. ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সাধারণ নির্বাচন ও ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনঃ

১৯৫৪ সালে ১০ই মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তান শাষকগোষ্ঠী বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০শে মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। ১৯৫৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হলে বাঙালিদের মধ্যে বিপুল সাড়া দেখা দেয়। জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি, অতএব এই নির্বাচনের ফলাফল চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সময়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর    পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন তুলে নেয়া হ'লে ছাত্র সমাজ অধিকারের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।

৪. ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনঃ

পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে এই সময় দেশব্যাপী শাসন তুলে নেয়ার পর ছাত্রদের এই আন্দোলন নতুন করে গণ-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে ১৭ই সেপ্টেম্বর নিহত হন যার মধ্যে ওয়াজিউল্ল­া, মোস্তফা ও বাবুল অন্যতম। ছাত্র সমাজের ২২ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে ১৭ই সেপ্টেম্বর ’৬৩ ‘শিক্ষা দিবস’ পালন উপলক্ষে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলসমূহ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ছাত্রদের এই আন্দোলনের সবরকম সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে।

৫. ছাত্র সমাজের সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্ত্ততিঃ

পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটা অসম্ভব বিবেচনা করে তৎকালীন ছাত্র সমাজের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ১৯৬২ সালে গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দেন জনাব সিরাজুল আলম খান, জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এই সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্ল­বী পরিষদ’ নামে পরিচিত ছিল।

৬. ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলনঃ

১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধের সময়কালে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয় পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত ছিল। স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের ধারাবাহিকতায় পূর্ববাংলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এই বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে আহুত ‘সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলন’ শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা দাবী উপস্থাপন করেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘গত দুই যুগ ধরে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করা হয়েছে তার প্রতিকারকল্পে এবং পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক দূরত্বের কথা বিবেচনা করে আমি ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করছি।’ পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবি বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ হিসাবে বিবেচিত হয়।

৭. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাঃ

বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের এক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সংগঠনের কোন এক সদস্যের অসতর্কতার ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯শে জুন ‘৬৮ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এক রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।

১৯শে জুন ১৯৬৮, ঢাকা সেনানিবাসে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচার কার্য চলার সময় থেকে শ্লোগান ওঠে- ‘জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব।’ এই গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বলা যায়, এই সময় সমস্ত দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে।

৮. ’৬৯ এর গণ-আন্দোলনঃ

পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক শ্লোগান পরিবর্তিত হয়। ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা। ‘জাগো জাগো-বাঙালি জাগো’। এই ধারাবাহিকতায় স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে উন্মক্ত করে। অহিংস আন্দোলন সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। এই সময় রাজনৈতিক দলের ৬ দফা দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বাঙালি একক জাতিসত্তার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই গণ-আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ২০শে জানুয়ারী’ ৬৯ ছাত্র আসাদুজ্জামান এবং ২৪শে জানুয়ারী’৬৯ স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান মৃত্যুবরণ করে। ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকায় শহীদ আসাদ-মতিউর দুটি উল্লেখযোগ্য নাম। শেরে বাংলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ এবং বঙ্গভবনের সামনের উদ্যানের নাম ‘মতিউর রহমান শিশু উদ্যান’ করা হয়। জানুয়ারী ’৬৯ এ গৃহিত ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে।

১৫ই ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ই ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই মৃত্যু সংবাদ গণ-আন্দোলনে আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে। প্রচন্ড-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ এই মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। ২২শে ফেব্রুয়ারি’ ৬৯, শেখ মুজিবর রহমানসহ অভিযুক্ত সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি’ ৬৯ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণ-সম্বর্ধনায় শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এই মামলায় অভিযুক্ত ও বন্দী অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ডঃ শামসুজ্জোহাকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। উভয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শামসুজ্জোহা হল’ তাদের স্মরণে নামকরণ করা হয়েছে।

’৬৯ এর এই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দর, রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, দীপা দত্ত, হায়দর আকবর খান রণোসহ অনেকে।

রাজনৈতিক দলীয় প্রধান যাদের নিরলস পরিশ্রম ও নির্দেশনায় বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের এই আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করেছিল তাদের মধ্যে জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, শ্রীমনোরঞ্জন ধর অন্যতম।

৯. ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনঃ

২৫শে মার্চ ৬৯ সারা দেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণ-দাবিকে উপেক্ষা করার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে এক ব্যক্তি এক ভোটের নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ৭ই ডিসেম্বর ’৭০ থেকে ১৯শে ডিসেম্বর’ ৭০ এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তফসিল ঘোষণা করা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৬ দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে রায় প্রদান করে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে।

‘বাঙালির শাসন মেনে নেওয়া যায় না’ এই নীতিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগণ নির্বাচিত এই  জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার জাতীয় নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় অধিকারের সংঘাত। ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ৭০ এ বঙ্গবন্ধু এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে পূর্ব বাংলার ম্যাপ অংকিত একটি পতাকা প্রদান করেন। এই পতাকাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়। ছাত্রদের এই সংগঠন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়া। জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনে ছাত্র ও যুব সমাজের অংশগ্রহণ জন সমাজকে আরো উৎসাহিত করে তোলে।

১০. ’৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনঃ

নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত দিতে অস্বীকার করেন। একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছে। তারা সরকার গঠন করবে, এটাই ছিল বাস্তবতা। কিন্তু সামরিক শাসকগণ সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে এক আলোচনা শুরু করে। কিসের জন্য আলোচনা, এটা বুঝতে বাঙালি নেতৃবৃন্দের খুব একটা সময় লাগেনি। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১লা মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগের আহবান জানান। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২রা মার্চ ৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ৩রা মার্চ ’৭১ এ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে ‘স্বাধীনতার ইসতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইসতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত সরকার জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কোন সমাধান না দেওয়ায়, ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিকনির্দেশনী ভাষণে সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্ত্তত হতে আহবান জানান। এই ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। ......... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হিসাবে বিবেচিত।

৭ই মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোন দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না। ছিল একজন জাতীয় নেতার নির্দেশ। এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে। ২রা মার্চ ৭১ থেকে পূর্ব বাংলার সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।

২৩শে মার্চ ৭১ সকালে পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে এই বাহিনীর নেতৃবৃন্দ মিছিল সহকারে বাংলাদেশের পতাকাসহ বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িতে এই পতাকা উত্তোলন করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে এই পতাকা লাগান হয়। ২৩শে মার্চ পূর্ব বাংলার প্রতিটি শহরে পাকিস্তান দিবসের অনুষ্ঠান বর্জিত হয় এবং   পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়।

অন্যদিকে ক্ষমতার হস্তান্তরের নামে এই আলোচনা চলা অবস্থায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র  জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সৃষ্ট সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে নতুন করে সংকটের সৃষ্টি করে। অযৌক্তিক দাবি উপস্থাপনের ফলে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানের পথ এক সময় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সামরিক শাসকগণ স্বার্থান্বেষী মহলের সাথে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের জন্য রাজনৈতিক আলোচনার আড়ালে সামরিক বাহিনী মাত্র ২২ দিনে দুই ডিভিশন অবাঙালি সৈন্য পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরে সক্ষম হয়। বাস্তবতায় এটিই ছিল তাদের আলোচনার নামে কালক্ষেপণের মূল উদ্দেশ্য। ২৪শে মার্চ ৭১ সামরিক শাসকগণ হেলিকপ্টার যোগে সমস্ত সেনানিবাসে এই আক্রমণের পরিকল্পনা হস্তান্তর করে। বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই কুখ্যাত হত্যাযজ্ঞের নির্দেশ নামা ‘‘অপারেশন সার্চ লাইট’’ নামে পরিচিতি।

২৫শে মার্চ ৭১ রাত্র ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিয়ে সেনানিবাস অথবা আক্রমণ প্রস্ত্ততিস্থানগুলি ত্যাগ করে। একই সাথে ঢাকাসহ দেশের সমস্ত বড় শহর ও সেনানিবাসের বাঙালি রেজিমেন্টসমূহ আক্রান্ত হয়। সেনাবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডি বাসভবন থেকে বন্দী হবার পূর্বে তিনি দলীয় নেতৃবন্দেকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়।

১১. অপারেশন সার্চলাইট ও ২৫ মার্চের গণহত্যাঃ 

২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত এই গণহত্যাটি ‘‘অপারেশন সার্চলাইট’’ নামে পরিচিত। এ গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত সকল বাঙালি অফিসারদের হত্যা কিংবা গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হয়। ঢাকার পিলখানায়, ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ই বি আর সিসহ সারাদেশের সামরিক আধাসামরিক সৈন্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের কথা যেন বহির্বিশব না জানতে পারে সে জন্য আগেই সকল বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং অনেককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব এই গণহত্যা সম্পর্কে অবগত হয়। আলোচনার নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণও এই গণহত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল।

 Image

২৫ মার্চ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানিদের অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ঢাকা বিশববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশববিদ্যালয় ও আশেপাশের বহু সংখ্যক শিক্ষক ও সাধারণ কর্মচারিদেরও হত্যা করা হয়। পুরোনো ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও চালানো হয় ব্যাপক গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে হত্যা করা হয় পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্যকে। পিলখানার ইপিআর-এর কেন্দ্রে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র সদস্যদের। কয়েকটি পত্রিকা অফিস ভস্মীভূত করা হয়। দেশময় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত নর-নারীকে। হত্যা করা হয় শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদেরও। ধারণা করা হয়, সেই রাত্রিতে একমাত্র ঢাকা  ও তার আশে পাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ নর-নারীর জীবনাবসান ঘটে।  

১২. স্বাধীনতার ঘোষণাঃ

 Image

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তিনি পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহবান জানান। চট্ট্রগ্রামে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারের জন্য পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণাটিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, নবগঠিত এই রাষ্ট্রের সরকার জোটবদ্ধ না হয়ে বিশেবর অপর রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী। এছাড়াও এ ঘোষণায় সারা বিশেবর সরকারগুলোকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র: মুজিবনগর প্রশাসন, তৃতীয় খন্ড, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৯৮২) 

১৩.    গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনঃ

১০ই এপ্রিল ৭১ নির্বাচিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসস্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এই সরকার স্বাধীন সার্বভৌম ‘‘গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’’। স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) বলে এই সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়।  ১৭ই এপ্রিল ৭১ মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথ তলায় ‘‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’’ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির এই সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পীকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। যে সমস্ত নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় তাঁরা হলেনঃ

১।       রাষ্ট্রপতি          বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দী)

২।       উপ-রাষ্ট্রপতি     সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি)

৩।       প্রধানমন্ত্রী        তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

৪।       অর্থমন্ত্রী           ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

৫।       পররাষ্ট্রমন্ত্রী       খন্দকার মোশতাক আহমেদ (আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

৬।      স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী        এ এইচ এম কামরুজ্জামান (ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

এই অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সরকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশ বিদেশের শতাধিক সাংবাদিক ও হাজার হাজার দেশবাসীর উপস্থিতিতে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংসদ জনাব আবদুল মান্নান। নবগঠিত সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘‘মুজিব নগর’’।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি ‘‘সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ’’ গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেনঃ

ক)      জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসভাপতি                 ন্যাপ ভাসানী

খ)       শ্রী মনি সিং                                   সভাপতি        বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি

গ)       অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ              সভাপতি        ন্যাপ মোজাফ্ফর

ঘ)       শ্রী মনোরঞ্জন ধর                              সভাপতি        বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস

ঙ)       জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ                  প্রধানমন্ত্রী       পদাধিকারবলে

চ)       খন্দকার মোশতাক আহমেদ                পররাষ্ট্রমন্ত্রী      পদাধিকারবলে

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় উপস্থাপনসহ এবং একটি সময় উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ দেশত্যাগী এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দান করেন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোয় কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গঃ

১।       যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রশাসনিক কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনঃ

ক)      রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা         জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, এম এন এ

খ)       প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা                            ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, এম এন এ

গ)       তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত                     জনাব আবদুল মান্নান, এম এন এ

ঘ)       জয় বাংলা পত্রিকার উপদেষ্টা                 জনাব জিল্লুর রহমান, এম এন এ

ঙ)       যুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদ চেয়ারম্যান      অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম এন এ

২।       বেসামরিক প্রশাসনঃ

 ক)      ক্যাবিনেট সচিব          জনাব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)

খ)       মুখ্য সচিব                 জনাব রুহুল কুদ্দুস

গ)       সংস্থাপন সচিব           জনাব নূরুল কাদের খান

ঘ)       অর্থ সচিব                 জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান

ঙ)       পররাষ্ট্র সচিব             জনাব মাহাবুবুল আলম চাষী এবং জনাব আবুল ফতেহ

চ)       প্রতিরক্ষা সচিব           জনাব এম এ সামাদ

ছ)       স্বরাষ্ট্র সচিব               জনাব এ খালেক

জ)      স্বাস্থ্য সচিব                জনাব এস টি হোসেন

ঝ)      তথ্য সচিব                 জনাব আনোয়ারুল হক খান

ঞ)      কৃষি সচিব                জনাব নুরউদ্দিন আহমেদ

ট)       আইন সচিব               জনাব এ হান্নান চৌধুরী

৩।       কুটনৈতিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেনঃ

ক)      মিশন প্রধান যুক্তরাজ্য, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (বহিঃর্বিশ্বে সরকারের বিশেষ দূত)

খ)       মিশন প্রধান কলিকাতা, জনাব হোসেন আলী

গ)       মিশন প্রধান নতুন দিল্লী, জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

ঘ)       মিশন প্রধান যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জনাব এম আর সিদ্দিকী

ঙ)       মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরাক, জনাব আবু ফতেহ

চ)       মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত সুইজারল্যান্ড, জনাব অলিউর রহমান

ছ)       মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিলিপাইন, জনাব কে কে পন্নী

জ)      মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেপাল, জনাব মোস্তাফিজুর রহমান

ঝ)      মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত হংকং, জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ

ঞ)      মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত জাপান, জনাব এ রহিম

ট)       মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত লাগোস, জনাব এম এ জায়গীরদার

 ৪।       স্বাধীন বাংলাদেশের গণমুখী প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে সেই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পরিকল্পনা কমিশন একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেনঃ

(ক)     ডঃ মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী

(খ)      ডঃ মোশারাফ হোসেন

(গ)      ডঃ খান সরওয়ার মুরশিদ  

(ঘ)      ডঃ এম আনিসুজ্জামান

(ঙ)      ডঃ স্বদেশ বোস।

৫।       মুক্ত এলাকায় সুষ্ঠু প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেখাশুনা ও যুব শিবির পরিচালনার জন্য সরকার সমস্ত বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রশাসনিক এলাকায় চেয়ারম্যান ও প্রশাসক নিয়োগ করেন।

১৪.    স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রঃ

মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং অবরুদ্ধ এলাকার জনগণের মনোবল অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নীতি নির্ধারণী ভাষণসহ জনগণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নির্দেশাবলী প্রচারিত হয়। প্রতিদিনের সংবাদসহ যে সমস্ত অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তার মধ্যে চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার অন্যতম। যে সমস্ত ব্যক্তির অক্লান্ত পরিশ্রমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তাঁরা হলেনঃ

সর্বজনাব এম এ মান্নান এম এন এ, জিল্লুর রহমান এম এন এ, শওকত ওসমান, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ মযহারুল ইসলাম, ডঃ আনিসুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, কল্যাণ মিত্র, ফয়েজ আহমদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল, তোয়াব খান, আসাদ চৌধুরী, কামাল লোহানী, আলমগীর কবীর, মহাদেব সাহা, আলী যাকের, সৈয়দ হাসান ইমাম, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল জববার, আপেল মাহমুদ, রর্থীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, ডাঃ অরূপ রতন চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, সমর দাস, অজিত রায়, রাজু আহামেদ, মামুনুর রশীদ, বেগম মুশতারী শফি, শাহীন মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, ডালিয়া নওশীন, মিতালী মুখার্জী, বুলবুল মহলানবীশ, শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান খান, সৈয়দ আবদুস সাকেরসহ অনেকে।

১৫.    বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীঃ

যে জনযুদ্ধ এনেছে পতাকা, সেই জনযুদ্ধের দাবিদার এদেশের সাত কোটি বাঙালি। একটি সশস্ত্র যুদ্ধ দেশকে শত্রুমুক্ত করে। এই সশস্ত্র যুদ্ধ একটি নির্বাচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। পরিকল্পিত এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ই এপ্রিল ’৭১ বাংলাদেশ সরকার সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি যুদ্ধঅঞ্চলে বিভক্ত করেন। এই ৪টি অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেনঃ

ক)      চট্টগ্রাম অঞ্চল - মেজর জিয়াউর রহমান

খ)       কুমিল্লা অঞ্চল - মেজর খালেদ মোশাররফ

গ)       সিলেট অঞ্চল - মেজর কে এম সফিউল্লাহ

ঘ)       দক্ষিণ পশ্চিম - অঞ্চল মেজর আবু ওসমান চৌধুরী

পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে বিভক্ত করে রাজশাহী অঞ্চলে মেজর নাজমুল হক, দিনাজপুর অঞ্চলে মেজর নওয়াজেস উদ্দিন এবং খুলনা অঞ্চলে মেজর জলিলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ৭ই জুলাই ৭১ যুদ্ধের কৌশলগত কারণে সরকার নিয়মিত পদাতিক ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনায় ‘জেড ফোর্স’ ব্রিগেড গঠন করেন। এই জেড ফোর্সের অধিনায়ক হলেন লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান। একই ভাবে সেপ্টেম্বর মাসে ‘এস ফোর্স’ এবং ১৪ই অক্টোবর ‘কে ফোর্স’ গঠন করা হয়। কে ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল খালেদ মোশাররফ এবং এস ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল কে. এম. সফিউল্লাহ।

১০ই জুলাই ৭১ থেকে ১৭ই জুলাই ৭১ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে যুদ্ধ অঞ্চলের অধিনায়কদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে বাংলাদেশকে ১১টি যুদ্ধ সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এই কমান্ডারগণ ছিলেনঃ

সেক্টর                  অধিনায়ক যুদ্ধ                                             এলাকা ও তথ্য

সেক্টর-এক         মেজর রফিকুল ইসলাম            চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার ফেনী

মহকুমার অংশ বিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্বপাড় পর্যন্ত)। এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল পাঁচটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ২১০০ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ২০,০০০।

 

সেক্টর-দুই          মেজর খালেদ মোশাররফ           কুমিল্লা জেলার অংশ, ঢাকা জেলা ও ফরিদপুর জেলার 

অংশ এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল ছয়টি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ৪,০০০ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ৩০,০০০।

 

সেক্টর-তিন         মেজর কে এম শফিউল্লাহ          কুমিল্লা জেলার অংশ, ময়মনসিংহ জেলার অংশ, ঢাকা ও

সিলেট জেলার অংশ।এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল সাতটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ৬৬৯৩ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ২৫,০০০।

 

সেক্টর-চার         মেজর সি আর দত্ত                    সিলেট জেলার অংশ।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল ছয়টি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ৯৭৫ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ৯,০০০।

 

সেক্টর-পাঁচ         মেজর মীর শওকত আলী           সিলেট জেলার অংশ ও ময়মনসিংহ জেলার অংশ।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল ছয়টি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ১৯৩৬ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ৯,০০০।

 

সেক্টর-ছয়   উইং কমান্ডার এম খাদেমুল বাশার      রংপুর জেলা ও দিনাজপুর জেলার অংশ।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল পাঁচটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ২৩১০ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ১১,০০০।

 

সেক্টর-সাত         মেজর নাজমুল হক                  রংপুর জেলার অংশ, রাজশাহী জেলার অংশ, পাবনা জেলার

অংশ ও দিনাজপুর জেলার অংশ, বগুড়া জেলা।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল নয়টি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ২৩১০ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ১২,৫০০। সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মেজর নাজমুল হক নিহত হওয়ার পর লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

 

সেক্টর-আট         মেজর আবু ওসমান চৌধুরী        যশোর জেলা, ফরিদপুর জেলা, কুষ্টিয়া জেলা, খুলনা ও

বরিশাল জেলার অংশ।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল সাতটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ৩৩১১ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ৮,০০০। ১৮ই আগস্ট লেঃ কর্নেল এম আবুল মঞ্জুর সেক্টর অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

 

সেক্টর-নয়          মেজর আবদুল জলিল              বরিশাল জেলার অংশ, পটুয়াখালী জেলা, খুলনা, ফরিদপুর

জেলার অংশ।

এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল তিনটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ৩৩১১ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ৮,০০০।

সেক্টর-দশ          প্রধান সেনাপতির নিয়ন্ত্রণে (নৌ সেক্টর) সমগ্র বাংলাদেশ। এই সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল নৌ-কমান্ডোদের দিয়ে। বিভিন্ন নদী বন্দর ও শক্র পক্ষের নৌ-যানগুলোতে অভিযান চালানোর জন্য এঁদের বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। লক্ষ্যবস্ত্তর গুরুত্ব এবং পাকিস্তানিদের প্রস্ত্ততি বিশ্লেষণ করে অভিযানে সাফল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হতো এবং তার ওপর নির্ভর করত অভিযানে অংশগ্রহণকারী দলসমূহে যোদ্ধার সংখ্যা কত হবে। যে সেক্টর এলাকায় কমান্ডো অভিযান চালানো হতো, কমান্ডোরা সেই সেক্টর কমান্ডারের অধীনে কাজ করত। নৌ-অভিযান শেষে তারা আবার তাদের মূল সেক্টর- ১০ নম্বর সেক্টরের আওতায় চলে আসত। নৌ-কমান্ডোর সংখ্যা ছিল ৫১৫ জন।

সেক্টর এগার     মেজর আবু তাহের।                   ময়মনসিংহ জেলার অংশ, সিলেট জেলার অংশ ও

রংপুর জেলার অংশ। এই সেক্টরের সাব-সেক্টর ছিল সাতটি। সেক্টর ট্রুপস্ ছিল ২৩১০ সৈন্য এবং গেরিলা ছিল ২৫,০০০। মেজর আবু তাহের ১৪ নভেম্বর আহত হওয়ার পর এই সেক্টরের দায়িত্ব কাউকেও দেয়া হয়নি।

১৬.    মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরঃ

ক) প্রধান সেনাপতি মুক্তিবাহিনী                   কর্নেল এম এ জি ওসমানী

খ) সেনাবাহিনী প্রধান                                 কর্নেল আবদুর রব

গ) বিমানবাহিনী প্রধান ও উপ-সেনা প্রধান        গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার

ঘ) ডাইরেক্টর জেনারেল মেডিকেল সার্ভিসমেজর শামছুল আলম

 পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মোট ১৩১ জন অফিসার মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ৫৮ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মূর্তি অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে যুদ্ধে যোগদান করেন। এ কোর্স-কে প্রথম বাংলাদেশ সর্ট সার্ভিস কোর্স বলা হয়। ৬৭ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয় সর্ট সার্ভিস কোর্সে ভর্তি করা হয় এবং তারা ১৯৭২ সনে কমিশন প্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে ১৩ জন সামরিক অফিসার যুদ্ধ অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। ৪৩ জন সামরিক অফিসারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ এবং তার কয়েকদিনের মধ্যে হত্যা করে।

১৭.    মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীঃ

ক।      পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে আসা বাঙ্গালী অফিসার, ক্যাডেট ও বিমানসেনারা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মোট প্রায় ৩৫ জন অফিসার ও ক্যাডেট  এবং প্রায় ৫০০ বিমানসেনা   পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।  এইসব বিমান বাহিনীর সদস্যরা যদিও স্থলযুদ্ধে খুবই বিরোচিত ভুমিকা রাখছিলেন তবুও তাদের মধ্যে একটি স্বাধীন বিমান বাহিনী গঠনের চেতনা খুব প্রবল ভাবে কাজ করছিল। এই চেতনা নিয়েই কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পাইলট ভারতীয় বিমান বাহিনী, ভারতীয় সরকার এবং বাংলাদেশ ফোর্সেস (বিডি এফ) এর সাথে বিভিন্ন রকমের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

খ।       কিলো ফ্লাইট :    ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি ভারত সরকার অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে একটি স্বাধীন বিমান বাহিনী গঠনের জন্য আমেরিকায় তৈরী ১টি পুরানো ডিসি-৩ বিমান, কানাডার তৈরী ১টি অটার বিমান এবং ফ্রান্সের তৈরী ১টি এ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার দেয়। এর সাথে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে একটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিত্যক্ত রানওয়ে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এই সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়।  বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।  সশস্ত্র বিমান বাহিনী গঠনে  গোপনীয়তা রক্ষার্থে এর গুপ্ত নাম হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। ‘কিলো ফ্লাইটের’ অস্তিত্ব বিডি এফ এবং গোটা কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া আর কেউ জানতেন না।  কিলো ফ্লাইটে বিমান বাহিনীর পাইলটদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন পি আই এ  এবং প্লান্ট প্রটেকশনের পাইলট এসে যোগ দেন। বিভিন্ন সেক্টর হতে যুদ্ধরত মোট ৫৮ জন বিমানসেনাকে এই ফ্লাইটে নিয়ে আসা হয়। এই ফ্লাইটের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয় স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদকে।  এই সব অত্যুৎসাহী বিমান বাহিনী সদস্যদের সমন্বয়ে  ১৯৭১ এর ২৮ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর  উদ্ধোধন  হয়।  শুরু হয় কঠোর প্রশিক্ষণ। এই ফ্লাইট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট এলাকায় মোট ৫০টি অভিযান সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করে। এদের মধ্যে মোগলহাটে (১৫ অক্টোবর ৭১), লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁয়ে (১৬ অক্টোবর ৭১), চৌগাছায় (২১ নভেম্বর ৭১), গোদনাইল ও পতেঙ্গায় (৩ ডিসেম্বর ৭১), সিলেটে (৪ ডিসেম্বর ৭১), জামালপুরে (৫ ডিসেম্বর ৭১),  মেঘনা নদীতে (৬ ডিসেম্বর ৭১), সিলেটে (৭ ডিসেম্বর ৭১) এবং নরসিংদীতে  (১১ ডিসেম্বর ৭১) বিমান হামলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৮.    মুক্তিযুদ্ধে নৌ-বাহিনীঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙ্গালী অফিসার ও নাবিকগণ পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করে দেশে এসে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী গঠন করেন। ভারত থেকে প্রাপ্ত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামের ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সমস্ত নাবিকগণ শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। পাশাপাশি ‘ অপারেশন জ্যাকপট’ নামে নির্ভীক ডুবুরীদল সমুদ্র ও নদী বন্দর সমূহে বিধংসী আক্রমণ পরিচালনা করেন। এতে হানাদার বাহিনীর ২৬ টি জাহাজ ধ্বংস হয় ও সমুদ্র পথ কার্যতঃ অচল হয়ে পড়ে। নৌ বাহিনীর অপারেশনের মধ্যে হিরণ পয়েন্টের মাইন আক্রমণ (১০ নভেম্বর ৭১), মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌযান ধ্বংস (১২ নভেম্বর ৭১), চালনা বন্দরে নৌ হামলা (২২ নভেম্বর ৭১), চট্টগ্রাম নৌ অভিযান (০৫ ডিসেম্বর ৭১), পাকিস্তান নৌ ঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর অভিযান (১০ ডিসেম্বর ৭১) উল্লেখযোগ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌ বাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযানে শক্রপক্ষ নৌ পথে দিশেহারা হয়ে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বহুসংখ্যক নৌ সদস্য শাহাদৎ বরণ করেন। তাঁদের বীরত্ব ও আত্নত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ শহীদ রুহুল আমিন, ইআরএ-১, কে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করা হয়। এছাড়া ০৫ জনকে বীর উত্তম, ০৮ জনকে বীর বিক্রম এবং ০৭ জনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌ বাহিনীর ভূমিকাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

১৯.    ব্রিগেড সংগঠন ও অপারেশনঃ

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকটা ছিল গেরিলাভিত্তিক কিন্তু এভাবে গেরিলা যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর সুশিক্ষিত সৈন্যদের পদানত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছিল না। ফলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনয়ন ও মুক্তাঞ্চল গঠনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর গঠন বিন্যাসের পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা গৃহীত হয়।  এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী সেনাবাহিনীর  সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সম্মুখ সমরের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। এরা হচ্ছেঃ

ক) জেড ফোর্স-লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমানের নামানুসারে জুলাই ৭১ সনের ৭ই জুলাই গঠিত হয় এই বিগ্রেড যার নাম করা হয় জেড ফোর্স। এই ফোর্সের অন্তর্ভূক্ত ছিল ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ২ ফিল্ড ব্যাটারি আর্টিলারি ও একটি সিগন্যাল কোম্পানী। জুলাই ৭১ থেকে সেপ্টেম্বর ৭১ পর্যন্ত জেড ফোর্স ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও রৌমারী এলাকায় যুদ্ধরত থাকে। অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত তারা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকায় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। জেড ফোর্সের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সমূহ ছিল কামালপুর যুদ্ধ, বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশন, দেওয়ানগঞ্জ থানা আক্রমণ, নকসী বিওপি আক্রমন, চিলমারীর যুদ্ধ, হাজীপাড়ার যুদ্ধ, ছোটখাল, গোয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, লামাকাজি, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলই, ধামাই চা বাগান, জকিগঞ্জ, আলি  ময়দান, সিলেট এমসি কলেজ, ভানুগাছা, কানাইঘাট, ফুলতলা চা বাগান, বড়লেখা, লাতু, সাগরনাল চা বাগান, ছাতক ও রাধানগর।

খ) কে ফোর্স-লেঃ কর্নেল খালেদ মোশাররফের নামানুসারে সেপ্টেম্বর ৭১ সনে গঠিত হয় এই বিগ্রেড যার নাম করা হয় কে ফোর্স। এই ফোর্সের অন্তর্ভূক্ত ছিল ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১ ফিল্ড ব্যাটারি (মুজিব ব্যাটারী) আর্টিলারি ও একটি সিগন্যাল কোম্পানী। কে ফোর্সের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সমূহ ছিল দেউশ মন্দভাগ অভিযান, শালদা নদী অভিযান, পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুলগাজী, নিলক্ষ্মীর যুদ্ধ, বিলোনিয়ার যুদ্ধ, চাপিলতার যুদ্ধ, কুমিল্লা শহরের যুদ্ধ, নোয়াখালীর যুদ্ধ, কশবার যুদ্ধ, বারচরগ্রাম যুদ্ধ, মিয়াবাজার যুদ্ধ, গাজীপুর যুদ্ধ, সলিয়াদীঘি যুদ্ধ, ফেনী যুদ্ধ, চট্টগ্রাম বিজয় ও ময়নামতি বিজয়।

গ) এস ফোর্স-লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহর নামানুসারে অক্টোম্বর ৭১ সনে গঠিত হয় এই বিগ্রেড যার নাম করা হয় এস ফোর্স। এই ফোর্সের অন্তর্ভূক্ত ছিল ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, এস ফোর্সের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সমূহ ছিল ধর্মগড় আক্রমন, মনোহরদী অবরোধ, কলাছড়া অপারেশন, বামুটিয়া অপারেশন, আশুগঞ্জ অপারেশন, মুকুন্দপুর যুদ্ধ, আখাউড়া যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়ীয় যুদ্ধ, ভৈরব ও আশুগঞ্জ যু্দ্ধ, কিশোরগঞ্জ যুদ্ধ, হরশপুর যু্দ্ধ, নরসিংদী যুদ্ধ ও বিলোনিয়ার যুদ্ধ।

২০.    বি এল এফ (মুজিব বাহিনী)ঃ

বিশাল এই জনযুদ্ধে ছাত্র ও যুবক শ্রেণী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভুমিতে ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। ৬০ দশকের মাঝামাঝি এই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের পরিকল্পনায় সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রদের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্ত্ততি সমন্বিত করে। নেতৃস্থানীয় প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) ছাত্রকে এই বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি রাজনৈতিক যুদ্ধ অঞ্চলে বিভক্ত করে এই সমস্ত ছাত্রদেরকে নিজ নিজ এলাকার ভিত্তিতে অবস্থান নেয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়।

 এই ৪টি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণকারী নেতৃবৃন্দ ছিলঃ

ক) পূর্ব অঞ্চল                      জনাব শেখ ফজলুল হক মনি ও জনাব আ স ম আবদুর রব

খ) উত্তর অঞ্চল                     জনাব সিরাজুল আলম খান ও জনাব মনিরুল ইসলাম

গ) পশ্চিম অঞ্চল                   জনাব আবদুর রাজ্জাক ও জনাব সৈয়দ আহমদ

ঘ) দক্ষিণ অঞ্চল                    জনাব তোফায়েল আহমদ ও জনাব কাজী আরেফ আহমেদ

প্রশিক্ষণ শিবিরে কর্মরত ছিলেনঃ জনাব নূরে আলম জিকু, হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক ও মাসুদ আহমেদ রুমীসহ অনেকে। বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পার্টির তত্ত্বাবধানে ছাত্র সংগঠন সংগঠিত হয়। এই সশস্ত্র যুব শ্রেণীকে নেতৃত্ব দেন জনাব হারুনুর রশীদ, নূরুল ইসলাম নাহিদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ অনেকে। এ ছাড়াও জনাব কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এলাকা ভিত্তিক গড়ে ওঠা টাংগাইল মুক্তি বাহিনীর নাম উল্লেখ্যযোগ্য।

২১.    স্বাধীন বাংলা বেতারঃ

স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ট্রান্সমিশন ভবনে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সনে। ৩০ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান বিমান বাহিনী আক্রমণে তা ধ্বংস করা হয়। এর পর কিছু দিন আগরতলাতে এবং তারপর ২৫ মে ১৯৭১ কলকাতা থেকে সম্প্রচার নিয়মিত শুরু করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার বিশাল অবদান রাখে। চরম পত্র, রণাংগন কথিকা, রক্ত স্বাক্ষর, মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠান অগ্নিশিক্ষা, দেশাত্ত্ববোধক গান ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল।

২২. গণমাধ্যমঃ

স্বাধীনতার স্বপক্ষে বাংলাদেশ ও বিদেশে বাঙ্গালীদের উদ্দোগ্যে মুজিবনগর, মার্কিন যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র প্রকাশ করা। এই সব সংবাদপত্রে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা, বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম ও নির্দেশাবলী, নেত্রবৃন্দের বিবৃতি ও তৎপরতা, প্রবাসী বাঙ্গালীদের আন্দোলনের খবর ইত্যাদি প্রকাশিত হত। এদের মধ্যে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা, বাংলাদেশ, বঙ্গবাণী, স্বদেশ, রণাঙ্গন, স্বাধীন বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, সোনার বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, জন্মভূমি, বাংলারবাণী, নতুন বাংলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  এছাড়া মার্কিন যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজ লেটার, বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা, আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজ লেটার, বাংলাদেশ নিউজ বুলেটিন, শিক্ষা উল্লেখযোগ্য। কানাডা থেকে বাংলাদেশ স্ফুলিঙ্গ নামক সংবাদপত্র প্রকাশিত হত।

২৩.    পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তার সহযোগীরাঃ

২৬ শে মার্চ ’৭১ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে ২৬শে মার্চ এর পর বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি দখলদার বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এক সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সমগ্র জাতিকে একত্রিত করে বিদেশী বন্ধু ও সহযোগী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।

বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার এই সশস্ত্র অধ্যায়ে উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে মুক্তিকামী মানুষের উপর জঘন্য এবং পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যাকান্ড চালায়। এই নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে শহীদ হয় ৩০ লক্ষ নিরীহ নিরাপরাধ শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয় ২ লক্ষ ৫০ হাজারের অধিক বাংলার নারী। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় প্রায় এক কোটি মানুষ। সকলের একটি মাত্র অপরাধ ‘‘তারা ছিল বাঙালি’’। পাকিস্তানের সামরিক শাসকের দাম্ভিক উক্তি ‘‘ আমি মানুষ চাইনা- পূর্ব বাংলার মাটি চাই’’। এই পোড়া মাটির নীতিকে সমর্থন দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন এগিয়ে আসে।

২৪.    শান্তি কমিটিঃ

৪ঠা এপ্রিল ’৭১ জনাব নুরুল আমিনের নেতৃত্বে অধ্যাপক গোলাম আযম ও খাজা খয়েরউদ্দীন টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন এবং ‘‘নাগরিক কমিটি’’ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। ৬ই এপ্রিল ’৭১ অধ্যাপক গোলাম আযম ও হামিদুল হক চৌধুরী টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে  ‘‘নাগরিক শান্তি কমিটি’’ গঠনের প্রস্তাব দেন। ৯ই এপ্রিল ’৭১ ঢাকায় ১৪০ সদস্য নিয়ে ‘‘নাগরিক শান্তি কমিটি’’ গঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল ’৭১ এই কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘‘শান্তি কমিটি’’ রাখা হয় এবং জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে এই কমিটি গঠিত হয়। রাজাকার নির্বাচন, নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ এই কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল।

২৫. রাজাকার বাহিনীঃ

মে ’৭১ মওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে খুলনার আনসার ক্যাম্পে এই বাহিনী গঠিত হয়। তিনি এই বাহিনীর নামকরণ করেন ‘‘রাজাকার বাহিনী’’। এই বাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সহযোগী হিসাবে এই বাহিনী দায়িত্ব পালন করে। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে এই বাহিনীর অত্যাচারের চিহ্ন আজো বিদ্যমান।

২৬. আলবদর বাহিনীঃ

১৯৭১ এর আগস্ট মাসে ময়মনসিংহে এই বাহিনী গঠিত হয়। সম্পূর্ণ ধর্মীয় আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই বাহিনীর গঠন ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। এই বাহিনীর কার্যকলাপের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড অন্যতম। মিরপুর বধ্যভূমি এই বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য বহন করে।

২৭. শরণার্থীঃ

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরচিত আক্রমণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারতে গমন করেন। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৪১টি শরণার্থী শিবির স্থাপিত করা হয়। এই শিবিরগুলিকে মোট ৯,৮৯৯,৩০৫ বাংলাদেশী আশ্রয় গ্রহণ করেন। পশ্চিম বঙ্গে ৭,৪৯৩,৪৭৪, ত্রিপুরাতে ১,৪১৬,৪৯১, মেঘালয়ে ৬৬৭,৯৮৬, আসামে ৩১২,৭১৩ ও বিহারে ৮৬৪১ সংখ্যক বাংলাদেশী শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেন।

২৭. বিজয়ের পরিকল্পনা- সম্মিলিত চুড়ান্ত আক্রমণঃ

অক্টোবর ’৭১ মাসের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে সমস্ত সীমান্ত এলাকা ছেড়ে দিয়ে সেনানিবাস অথবা বড় বড় শহর ভিত্তিক অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা মুক্ত করেছিল। নভেম্বর ’৭১ এর প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত বাহিনী। এই পর্যায়ে বাংলাদেশের সমগ্র যুদ্ধ এলাকাকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে এই যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে সমন্বিত করে যুদ্ধ পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়। ৩রা ডিসেম্বর ’৭১ পাকিস্তান অতর্কিতভাবে ভারত আক্রমণ করলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তিত হয়। ৬ই ডিসেম্বর ’৭১ ভারত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে সমন্বিত এক যুদ্ধ পরিকল্পনায় সম্মিলিত বাহিনী প্রচন্ড বেগে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে।

এই চূড়ান্ত যুদ্ধে ভারতীয় ইষ্টার্ণ কমান্ড অংশ গ্রহণ করে। তাদের সদর দপ্তর ছিল কলকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়ামে এবং অধিনায়ক ছিলেন লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা। এই যুদ্ধে ভারতীয়দের তিনটি কোর (৭ টি ডিভিশন), একটি কমুইনিকেশন জোন, একটি প্যারা বিগ্রেড, ৩টি বিগ্রেড গ্রুপ, ১২টি মিডিয়াম রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ৪৮ টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারী, ১টি আরমার্ড রেজিমেন্ট, ২টি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আরমার্ড বিগ্রেড, ৩টি ইঞ্জিনিয়ার বিগ্রেড, ২৯ টি বিএসএফ ব্যাটালিয়ান অংশ গ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে ভারতীয়দের শহীদদের সংখ্যা ৬৯ জন অফিসার, ৬০ জন জেসিও ৩ জন এনসিও ও ১২৯০ জন সৈনিক। আহত হন ২১১ জন অফিসার, ১৬০ জন জেসিও, ১১ জন এনসিও এবং ৩৬৭৬ সৈনিক। এছাড়াও যুদ্ধে মিসিং হন ৩ জন জেসিও ও ৫৩ জন সৈনিক।

১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বর ’৭১ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ কে নিয়াজী। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ-সেনা প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এই অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক জনাব কাদের সিদ্দিকী। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। প্রতি বছর এই দিনটি ‘‘বিজয় দিবস’’ হিসাবে পালিত হয়।

 

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। ১৯৪৭ এর ভারত- পাকিস্তান বিভক্তের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এই সংক্ষুব্ধ হওয়ার পর্যায়টি ভাষা আন্দেলনের ক্ষেত্রে প্রথম রুপ লাভ করে। কারণ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্তকে এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। ফলে শুরু হয় বিক্ষোভ আন্দোলন। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয় রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। রংপুরের জনগণও এই ভাষা আন্দোলনে মিছিল শোভাযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতেকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ বৈষম্য এসব কিছুর বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। এক্ষেত্রে রংপুর পিছিয়ে থাকেনি। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ফলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেন ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’। এরপর ২৫ মার্চ এর ভয়াল কাল রাত্রির পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। রংপুরও এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠে।

স্বাধীনতাকামী রংপুরের মানুষ ৩ মার্চ প্রথম যুদ্ধ আরম্ভ করে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ রংপুরের শংকু সমজদার। ৩ মার্চে রংপুরে ৩ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং এদের প্রাণদানের মাধ্যমে শুরু হয় রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের সকল শ্রেণীর মানুষ অংশ গ্রহণ করেন। ৩ মার্চ থেকে ৫ মার্চ রংপুরে কারফিউ চলে। এ অঞ্চলের মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ করে ২৪ মার্চ। ২৮ মার্চ রোববার রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিল এক নবচেতনায়। স্বাধীনতা চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চল হতে লাঠিসোটা, তীর ধনুক, বল্লম ইত্যাদি সহযোগে রংপুর ক্যান্টমেন্ট আক্রমণ করে বেলা ৩.০০ টার দিকে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ রংপুরের মানুষ বিভিন্ন অঞ্চল হতে লাঠিশোঠা, তীর ধনুক, বল্লম,দা,কুড়াল ইত্যাদি সহযোগে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করে বেলা ৩.০০ ঘটিকার দিকে। এতে ক্যান্টমেন্টের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা এ সমস্ত বিক্ষুব্ধ জনতার উপর ঝাপিয়ে পরে এবং অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। রংপুরের অগনিত মানুষ প্রাণ দিয়ে সৃষ্টি করে এক অবিস্বরণীয় ঘটনা। ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুরের প্রথম গণহত্যা ঘটে দখিগঞ্জ হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। এরপর ক্রমান্বয়ে বলারখাইল গণহত্যা, ঝাড়ুদার বিল ও পদ্মপুকুরের গণহত্যা, জয়রাম আনোয়ার মৌজার গণহত্যা, সাহেবগঞ্জের গণহত্যা, লাহিড়ীরহাটের গণহত্যা, ঘাঘটপাড়ের গণহত্যা, নিসবেতগঞ্জ গণহত্যা, দমদমা ব্রীজ গণহত্যা, জাফরগঞ্জ গণহত্যা প্রভৃতি নৃশংস হত্যাকান্ডে রংপুরবাসী তাদের প্রিয়জনকে হারায়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলকসা অনুযায়ী৩০শে এপ্রিল ১৯৭১ রংপুর কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থারত (অধ্যাপক চিত্ত রঞ্জন, অধ্যাপক রাম কৃষ্ণ অধিকারী ও অধ্যাপক সুনীল চক্রবর্তী) অধ্যাপকগণকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যাকরে দমদমা ব্রিজের পার্শ্বে এক বাঁশঝাড়ে গণ কবর দেয়। এছাড়াও অধ্যাপক কালাচাদ রায় ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয় এবং এই ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় অধ্যাপক আব্দুর রহমান ও অধ্যাপক সোলায়মানকে। এ সময় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল ছিল রংপুর টাউন হল।

সময়ের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র রংপুরে। ১২ ডিসেমবর রংপুর সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র রংপুর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৩ ডিসেমবর গংগাচড়া থানায় সর্বপ্রথম ২১২ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ১৫ ডিসেমবর তিস্তা ব্রীজে হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। ১৬ ডিসেমবরও রংপুর শহর ও শহরতলীতে লড়াই চলতে থাকে। ১৭ ডিসেমবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল। নয়মাস অবরুদ্ধ মানুষ খুঁজে পায় মুক্তির আস্বাদন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অকুতোভয় দেশপ্রেম আর অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে রংপুরে উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্য।

৩ মার্চ শহীদ শংকু সমাদ্দার দিবস

 

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ হয় রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শংকু সমাদ্দার। ৭১ সালের ৩ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা দেশব্যাপী হরতাল সারাদেশের মতো রংপুরেও পালিত হয়। শংকু মারা যাওয়ার খবরে উত্তাল হয়ে উঠে রংপুর শহর। শুরু হয় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ। পরে পাক হানাদারদের গুলি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের ছুরিকাঘাতে শহরের বাটা গলির মুখে গিনি এক্সচেঞ্জের সামনে মারা যায় রংপুর কলেজের ছাত্র আবুল কালাম আজাদ এবং শহরের দেওয়ান বাড়ি রোডের জেনারেল বুট হাউসের সামনে রংপুর জজ কোর্টের পেশকার ওমর আলী। আহত হয় শতাধিক নিরস্ত্র মানুষ। শহরের স্টেশন এলাকার অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে প্রথম মিছিলকারী নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। এ ছাড়াও সেইদিন গুলির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পরে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায় রংপুর কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক মোহাম্মদ আলী ও শরিফুল আলম মকবুল। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে তত্কালীন প্রশাসন শহরে কারফিউ জারি করে।

 

২৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  ২৮ মার্চ সকাল ৯টার পর থেকে প্রায় ৪০/৫০ হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা, বল্লম, কুড়াল, খুন্তি, দা, তীর-ধুনকসহ পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত করতে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে। ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়ে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন রংপুরের অগণিত বীর জনতা। ২৫ মার্চ সারাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছিল। এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে শত শত মানুষ প্রাণ হারান। পরে তাদের লাশ নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়।

ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবসের বীর শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে রংপুর শহরের প্রবেশ দ্বার হিসেবে পরিচিত মডার্ন মোড়ে নির্মিতি স্মৃতি স্তম্ভ "অর্জন"।

 

ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুরে গণহত্যা

১৭ এপ্রিল রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার ৮নং রামনাথপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ সবুজ ভূমি হাজারো বাঙালির রক্তে  লাল হয়ে যায়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বৈরাগীর ঘুমটির কাছ থেকে দক্ষিণে বুজরুক হাজীপুর পর্যন্ত ঘিরে ফেলে। অপরদিকে বুজরুক হাজীপুর, খালিশা হাজীপুর, ঘাটাবিল, রামকৃষ্ণপুর, বাঁশবাড়ি, বানিয়াপাড়া, খোর্দ্দবাগবাড়, মাসানডোবাসহ আরো অন্যান্য এলাকার গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। একই সাথে চালায় গণহত্যা। সেদিনের গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয় পার্বতীপুরের বাচ্চু খান এবং কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার পর এরা দু’জনেই পালিয়ে যায় পাকিস্তানে। বেলা ২টা থেকে রামনাথপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে ধরে নিয়ে আসে ঝাড়ুয়ার বিল এবং পদ্মপুকুর এলাকায় গুলিতে  হত্যা করে প্রায় দেড় সহস্রাধিক মানুষকে।

 

জয়রাম আনোয়ার মৌজার গণহত্যা

২২ এপ্রিল রংপুর জেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নে গুলিতে ২৬ জনকে হত্যা করে পাক বাহিনী। পরদিন ভোরে বড় রাস্তার পূর্বদিকে পড়ে আছে লাশের সারি। লোকজন ভয়ে ভয়ে ১১টি লাশ একস্থানে কবর দেয়। রাস্তার পশ্চিম দিকে গ্রামবাসী ১৫টি লাশ পান। সব লাশেরই হাত বাঁধা ছিল। পরণে ছিলো সার্ট-প্যান্ট। গ্রামবাসীরা জানে না এরা কোথাকার মানুষ। সেদিন যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল তাদের সবারই পরিচয় ছিল তারা বাঙালি। 

 

সাহেবগঞ্জের হত্যাযজ্ঞ

১ মে শনিবার মধ্য রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী রংপুর জেলার সাহেবগঞ্জে ১৯ জন বাঙালি সৈনিককে হত্যা করে। সব লাশের হাত বাঁধা এবং একই রশি দিয়ে পেঁচানো ছিলো লাশগুলো। সবার পরণেই সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল। হানাদার বাহিনীর ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল এলাকাবাসী। তকেয়ারপাড় এলাকার ইমাম ছবিল উদ্দিন মুন্সী (প্রয়াত) পাশের গ্রাম থেকে কিছু মানুষ ডেকে এনে নিহতদের জানাজা শেষে ১৯ জনকে সেখানেই কবর দেন। 

 

লাহিড়ীর হাটের গণহত্যা

৭ মে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ৩২ জনকে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে লাহিড়ীর হাট পুকুরপাড়ে গুলিতে  হত্যা করে। নিহতরা হলেন রাধাবল্লভ এলাকার মনোয়ার হোসেন বেনু, সাতগাড়ার নওয়াব আলী বাপাত, পীরজাবাদের আব্দুল করিম, আজগার আলী, শাহ সেকেন্দার আলী, মিন্টু মিয়া, নয়া মিয়া প্রেসিডেন্ট’র পুত্র শাহ নূরুল আনাম। ওই ৩২ জনের লাশ পড়ে থাকে লাহিড়ীর হাট বধ্যভূমিতে। তাদের লাশ দাফন করার মতো এলাকায় ছিল না কোন মানুষ।

 

বালার খাইল হত্যাযজ্ঞ

১২ এপ্রিল মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘বালার খাইল’ এলাকায় ৩টি ট্রাকভর্তি চোখ, হাত-পা বাঁধা মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এ গণহত্যা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেন ২ সহোদর। একজন কমলা প্রসাদ অন্যজন তার ছোট ভাই। ১২ এপ্রিলে যারা প্রাণ হারান তাদের মধ্যে সৈয়দপুর থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সেখানকার বিশিষ্ট ডাক্তার এবং আওয়ামী লীগ নেতা জিকরুল হক ছিলেন।

 

নব্দীগঞ্জ বধ্যভূমি

১৩ এপ্রিল রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়কের পাশে নব্দীগঞ্জে পাক বাহিনী ইপিআর-এর ১১ সদস্যকে হত্যা করে। পরদিন স্থানীয় লোকজন জানাজা শেষে একই স্থানে ১১ জনকে কবর দেন। ঠাকুরগাঁও থেকে এসব ইপিআর বাহিনীর সদস্যদের এনে নব্দীগঞ্জে রাতের আঁধারে হত্যা করা হয়।

 

নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমি

একাত্তরের ২৩ মে ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ হাটে ৪০ জনকে গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। সেখানে পূর্ণ চন্দ্র শঙ্কর ও বণিকের লাশ পাওয়া গেলেও শৈলেন দত্তের লাশ ছিল না। ২৫ মে মধ্যরাতে শহরের গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে মুকুল ও চুনিকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। পরদিন নিসবেতগঞ্জের বধ্যভূমিতে মুকুলসহ অর্ধশত মানুষের লাশ পড়ে থাকে খোলা আকাশের নিচে।

 

দমদমা ব্রীজ বদ্ধভুমি :
৩০ মে ১৯৭১। মধ্যরাতে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অতর্কিতে ঢুকে পড়লো পাক হানাদার বাহিনীর কনভয়। গভীর রাতে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ক্যাম্পাসের  শিক্ষক কোয়ার্টার্স গুলোর বাসিন্দারা ভীত সন্ত্রস্ত। কোথাও কোন শব্দ নেই। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শঙ্কিত ক্যাম্পাস বাসী শুনতে পারলো হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ। গাড়ি থেকে নেমে মুখ বাঁধা কয়েকজন অবাঙ্গালী চিনিয়ে দিলোশিক্ষকদের কে কোন বাসায় থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে ধরে নিয়ে আসা হলো অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে।অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায় সহ্য করতে পারলেন না তাঁর পতিসহ অন্যান্য শিক্ষকদের উপরে এমন অমানুষিক নির্যাতন। এক ছুটে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং সাথে সাথে ঘাতকের দল তাঁকেও রেহাই দিলো না। রাইফেলের বাট দিয়ে মারধোর, বুট পড়া পায়ের লাথি মারতে মারতে সবাইকে টেনে হিঁচড়ে তোলা হলো গাড়িতে।কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে মিলিটারীদের গাড়ির কনভয় বের হয়ে এগিয়ে চললো রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে। প্রায় দেড় মাইল যাওয়ার পরে দমদমা ব্রীজ এর কাছে গিয়ে হানাদারদের কনভয় থামলো। রাস্তা সংলগ্ন একটি বাঁশের ঝাঁরে নিয়ে যাওয়া হলো হাত পিছ মোরা করে বাঁধা শিক্ষকদের। দাড় করিয়ে দেওয়া হলো  সারিবদ্ধভাবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠলো হানাদারদের রাইফেল। মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়লেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় এবং তাঁর সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়।

মৃতদেহগুলি সেখানেই রেখে চলে গেলো পাক বাহিনীর গাড়ি বহর। এলাকার লোকজন যারা গুলির শব্দ শোনার পর সারা রাত অজানা আশংকায় ভীত সন্ত্রস্ত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, পরদিন সকালে তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসলেন। বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তাঁরা। একজনের উপরে আর একজন এমনভাবে পড়ে রয়েছে কয়েকটি লাশ। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ৭ জুন তারিখে ঐ এলাকার মানুষ আবারও রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে হটাত করে শুনতে পারলেন গুলির শব্দ। একটি দুইটি নয়, থেমে থেমে সারা রাত ধরেই শোনা গেলো গুলির শব্দ এবং মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো একদল মানুষের আহাজারি। ঐদিন পাক হানাদারদের কনভয়ের সাথে তিনটি ট্রাক এসে থামলো দমদমা ব্রীজের পশ্চিম পাশে। ট্রাকগুলো থেকে নামিয়ে আনা হলো দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে। লাইন করিয়ে দাঁড় করিয়ে খুনের নেশার অমানুষ বনে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনীর হাতের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। অজস্র মানুষের আহাজারি এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পরা। এমন করে প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী চললো নির্মম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ।

দখিগঞ্জ বধ্যভূমি :

৭১ সালের ৩ এপ্রিল, শনিবার। রংপুর জেলায় ঘটেছিল এক অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ। হঠাত করেই মধ্য রাতে দখিগঞ্জ শ্মশানের কাছে গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে আশপাশের মানুষের। রংপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় সবার প্রিয় জররেজ ভাই(শহীদ এ্যাডঃ ইয়াকুব মাহফুজ আলী, যিনি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রংপুর শহরের নবাবগঞ্জ বাজারে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন) সহ ১১ জন বাঙ্গালীকে দখিগঞ্জ শ্মশানে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় লাইন ধরে দাঁড় করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে হায়েনার দল।নিমিষেই ঝরে যায় তরতাজা প্রাণ।সেই ধ্বংসযজ্ঞের সময় একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি গুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে পড়ে যান এবং তার শরীরের ওপর অন্যরা পড়েছিল বলে তার পায়ে গুলি লাগে। এতে পাক বাহিনী ভাবে তিনি মারা গেছেন। কিছুক্ষণ মৃত আরও দশ জনের সাথে শুয়ে থেকে পাক বাহিনী ঐ এলাকা ত্যাগ করার পরে কোন ক্রমে ঐ এলাকা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যদের সহযোগিতায় ভারতে চলে যান। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া সেই ব্যক্তি হচ্ছেন রংপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব তাজহাটের দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার)। তিনি এলাকায় পরিচিতি মন্টু ডাক্তার নামে।সে রাতে দখিগঞ্জ শ্মশানে সৈন্যদের হাতে যারা শহীদ হন তারা হলেনঃ
১) শহীদ এ্যাডঃ ইয়াকুব মাহফুজ আলী (জররেজ),সকলের প্রিয় জররেজ ভাই।

২) মোহাম্মদ মহরম

৩) শ্রী গোপাল চন্দ্র,

 ৪) উত্তম কুমার অধিকারী

৫)দুলাল মিয়া

৬) রফিক আলী

৭) সতীশ হাওলাদার

৮) দুর্গা দাস অধিকারী ও আরো দু’জন যাদের নাম পাওয়া যায়নি।

আজো কালের সাক্ষী হয়ে আছে রংপুরের দখিগঞ্জ শ্মশান বধ্যভূমি। বেশ কয়েক বছর আগে ঐ এলাকায় শহীদদের নাম লেখা একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।অবস্থান : রংপুর নগরীর প্রাণ কেন্দ্র জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে একটি রাস্তা রংপুরের আদি শহর মাহিগঞ্জের দিকে চলে গেছে। তাজহাটের মহারাজার নামানুসারে এই সড়কের নাম করন করা হয়েছে জি.এল রায় রোড। এই রাস্তা ধরে শহর থেকে মাহিগঞ্জ যাবার পথে দখিগঞ্জ এলাকা।দখিগঞ্জে যে শ্মশান রয়েছে, সেই শ্মশানের পাশেই এই বধ্যভূমির অবস্থান। 

ঘাঘটপাড়েরবধ্যভূমি
১৯৭১-এর ১৪ মে শুক্রবার। মধ্যরাতে রংপুর শহরের ক্যান্টনমেন্ট এলাকা সংলগ্ননিসবেতগঞ্জের আশপাশ ছিল প্রায় জনমানবশূন্য। দুমধ্যরাতের কিছুক্ষণ পর শুরু হলো একটানা গুলিবর্ষণ। প্রায় আধঘণ্টা পর পর  থেকে থেকে আবার বিকট শব্দ। রাতেই একসময় থেমে গেলো গুলির শব্দ। চলে গেল হায়েনাদের কনভয়। পরদিন ভোর বেলা সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এলো আশপাশের গ্রাম থেকে কিছু মানুষ। তারা এসে দেখেছে অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র। একগাদা লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল ঘাঘট নদীর পাড়ে। সেদিন শহীদদের সবার পরনে ছিল খাকি পোশাক। হাত পেছনের দিকে বাঁধা। হতভাগ্যরা সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট জন। নিসবেতগঞ্জ এলাকাবাসীর ধারণা, শহীদেরা সবাই ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। লাশের তাজা রক্তে লাল হয়েছিল ঘাঘট নদীর পানি। প্রাণভয়ের মাঝেও স্থানীয় দু’চারজন সিদ্ধান্ত নেয় লাশগুলো দাফন করার। ঐ দিন সকালে আটটার দিকে হঠাৎ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেপরোয়া ভাবে ছুটে এলো চার-পাঁচটি আর্মি ট্রাক। ভয়ার্ত মানুষের উদ্দেশে সেনারা বলেছিল ‘লাশগুলো যেন সেখানেই পড়ে থাকে। বাঙালিরা মুসলমান নয়। তাদের লাশের দাফন-কাফনের দরকার নেই'। বলেই ঘাতক সেনা দল চলে গেলো ক্যান্টনমেন্টের দিকে। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ জন আস্তে আস্তে সরে যেতে শুরু করলেন। বেলা গড়িয়ে এক সময় দূরের মসজিদের থেকে ভেসে আসলো জুম্মার নামাজের আযান। এই লাশগুলো শেষ পর্যন্ত পড়েই ছিল ঘাঘটের পাড়ে। আজো এদের পরিচয় জানতে পারেনি এলাকার লোকজন। তবে স্থানীয় লোক জনের ধারণা এরা সবাই ছিল বন্দি ইপিআর বাহিনীর সদস্য। এখানেই  রাস্তার পাশে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ "রক্ত গৌরব" নামের । যা স্মরণ করাচ্ছে শহীদদের কথা।


তথ্য সূত্র :
১) মুক্তিযুদ্ধে রংপুর : মুকুল মুস্তাফিজ
২) রঙ্গপুর-রংপুর, ইতিহাস থেকে ইতিহাসে : মোস্তফা তোফায়েল

রংপুর টাউন হলঃ

রংপুর অঞ্চলের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী রংপুর টাউন হল। প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহ্য ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হলের শরীর জুড়ে। এটি শুধু একটি অডিটোরিয়াম বা হল নয় অনেক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার। একদা মুখরিত হয়েছিলঅনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিকের পদচারণায়। এখান থেকেই অনেক ক্ষণজন্মা পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাঙালী সংস্কৃতির মুক্ত চিন্তার পথ দেখিয়েছেন। বহু সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কারের সাক্ষী হয়ে অনেক আনন্দ বেদনার কাব্য ধারণ করে রংপুর শহরের ঠিক মধ্যস্থানে কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হল। যার প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল “রংপুর নাট্য সমাজ গৃহ”।রংপুরের অনেক স্থাপনার সাথে মিশে রয়েছে কাকিনার রাজা মহিমা মহিমা রঞ্জন রায়ের নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষার প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকে অনগ্রসর বাঙালিকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরীর জন্য জমি দান করেন তিনি। এখনো রংপুর টাউন হল, কৈলাশরঞ্জন স্কুল, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী তারি মহিমার গৌরব গাথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই অঞ্চলের নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের জন্য ১৮৮৫ সালে তৎকালীন রঙ্গপুর নাট্য সমাজ (রংপুর ড্রামাটিক এ্যাসোসিয়েশন বা আর.ডি.এ) একটি রঙ্গমঞ্চ বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসেন কাকিনার রাজা মহিমা রঞ্জন রায়। ১৮৯১ সালে রংপুরের উৎসাহিত নাট্য সমাজকে একটি রঙ্গশালা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১০ বিঘা ৩ কাঠা জমি দান করেন। নির্মিত হয় রংপুর টাউন হল। নিশ্চয়ই তিনি কখনও ভাবেননিশিল্পকলা প্রদর্শনের রঙ্গমঞ্চটিতে এক দিন মানব সভ্যতার বর্বরতম গণ নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হবে। ১৯৭১ এ যুদ্ধের বিভীষিকায় অসংখ্য মানুষকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি ধারণ করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে রংপুর টাউন হল, যেন জীবন্ত ইতিহাস। একদিন যে রঙ্গমঞ্চে দর্শক নন্দিত হয়েছিল দত্তা, শর্মিষ্ঠা, কুলীনকুল সর্বস্ব, নীল দর্পণ, সীতা, ছেড়া তার, সিরাজুদ্দৌলা, ইডিপাস, মানময়ী গার্লস স্কুল এর মতো নাটক, আলো ঝলমল এই রঙ্গমঞ্চে নূপুরের ঝংকারে মানুষের হৃদয়ে জাগিয়েছিল সুরের ঢেউ ; একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেই রঙ্গমঞ্চে রচিত হলো পৈশাচিকতা, নৃশংসতা আর বর্বরতার এক নির্মম ইতিহাস। রংপুর নাট্য সমাজ গৃহ'র রঙ্গমঞ্চ রঞ্জিত হলো অজস্র জানা অজানা শহীদের রক্তে। অনেক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের জীবন্ত সাক্ষী রংপুর টাউন হলের সাথে মিশে আছে অনেক বেদনা ও কষ্টের ইতিহাস। হলের ইট পাথরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে ৭১ এর স্মৃতি গাথা, বীরাঙ্গনাদের আর্ত চিৎকার, গুমোট চাপা কান্না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এই টাউন হলকে পাক হানাদার বাহিনী বানিয়েছিল “গণ নির্যাতন কেন্দ্র”।বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনা হতো নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙ্গালী মানুষজনকে। যাদের একটি বড় অংশ ছিল কম বয়সী নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধরে আনা সেই সব নারীদের উপরে দিনের পর দিন চলতো পাশবিক নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস এই টাউন হলে চলেছে মানুষ রুপি হায়েনাদের নজিরবিহীন গণ ধর্ষণ, গণ নির্যাতন আর গণ হত্যা। যে হলে একদা মানুষ ছুটে আসতো সুরের মূর্ছনায় সেই হলের গ্রীন রুম, রিহার্সাল রুম আর মঞ্চে ধর্ষিতার ক্রন্দন আর বুকফাটা আর্তনাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়লো পুরো শহরের মানুষ। একাত্তরের ঐ নয় মাসে পাক হানাদারেরা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটির সহায়তায় এই গণ নির্যাতন কেন্দ্রে ঠিক কতো জন মুক্তিকামী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কত জন নারী সম্ম্রম হারিয়েছেন দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। রংপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন টাউন হল বধ্যভূমির প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ টাউন হলের পিছনে শিখা সংসদে গিয়ে পাকবাহিনীর নৃশংসতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। তখনও হলের ভিতর থেকে ভেসে আসছিল অসংখ্য নারীর করুণ আর্তনাদ। রঙ্গমঞ্চের গ্রীন রুমের সামনে থেকে কে যেন একজন“পানি পানি” বলে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। শিখা সংসদের পিয়ন নির্মল এগিয়ে যান গ্লাস হাতে। এক ঢোকে পানি পান করে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালেন সেই যুবতী মেয়েটি। তাঁর জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। জানা যায়নি তাঁর পরিচয়। সেদিন ৫০ জন বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করা হয় হলের ভিতর থেকে। কম বয়সী একটি মেয়ে নিজের আঙ্গুল কামড়ে রক্তাক্ত করে সেই রক্তে দেয়ালে লিখেছিলেন “আমি বাঁচতে চাই”। নরপশুরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে নিজ শহরে আসা মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন এগিয়ে যান হলের পিছনের দিকের ইঁদারার কাছে। বাতাসে লাশের গন্ধে তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। তার মধ্যেই তিনি এগিয়ে উকি দিলেন ইঁদারার ভিতরে। কিন্তু যা দেখলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। স্বপ্নেও ভাবেননি মানুষ এতোটা নৃশংস হতে পারে। ইঁদারার ভিতরে পড়ে ছিল অগণিত মানুষের মৃত দেহ। সরে আসলেন তিনি, এগিয়ে গেলেন কৃষি ফার্মের (বর্তমান শিল্প কলা একাডেমী হলের পিছনে চিড়িয়াখানায়) ঝোপ জংগলের দিকে। সেখানে তখন ৩০ লক্ষ শহীদদের মধ্যে অজ্ঞাত পরিচয়ের বেশ কয়েক জনের দেহাবশেষ নিয়ে টানা হেঁচড়া করছিল কুকুর-শেয়াল। পুরো কৃষি ফার্মে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলী। এতো টুকু দেখার পর আর পারেননি তিনি। সরে এসেছেন ঐ ক্যাম্পাস থেকে।পরদিন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে তিনি আবারও যান টাউন হলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গলিত-অর্ধ গলিত-ছিন্ন ভিন্ন দেহাবশেষ গুলো মাটি চাপা দিলেন তাঁরা। ১৯ ডিসেম্বর সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ১৬৭টি মাথার খুলি। পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেই ঐতিহাসিক ইঁদারা।