বুনন শিল্পে শতরঞ্চি, রংপুরের গৌরব, রংপুরের ঐতিহ্য
রংপুর শহরের উপকন্ঠে সেনানিবাসের পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত একখানি গ্রাম নিসবেতগঞ্জ যা শতরঞ্জি নামক শিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক উর্বর ভূমি। অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকের কথা। বৃটিশ নাগরিক মি. নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে নিসবেতগঞ্জের নাম ছিল পীরপুর। পীরপুর গ্রামে সে সময়ে মোট মোটা ডোরাকাটা রং-বেরংয়ের সুতার গালিচা বা শতরঞ্জি তৈরী হত। মি. নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি শতরঞ্জির গুণগতমান উন্নয়ন এবং এ শিল্পের প্রচার ও প্রসার এর লক্ষ্যে সহায়তা প্রদান করেন এবং উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক বিপণন ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করেন। এ শিল্পের মান উন্নয়ন ও বিপনণ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই মি. নিশবেতের নামানুসারে শতরঞ্জি সমৃদ্ধ এ গ্রামটির নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ।
রংপুর জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্য হচ্ছে শতরঞ্জি। ইতিহাস থেকে যদ্দুর জানা যায়, এয়োদশ শতাব্দীতেও এ এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিল। রাজা-বাদশাহদের গৃহে এর ব্যাপক কদর ছিল। মোঘল সম্রাট আকবর-এর দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত বলে ইতিহাস থেকে জানা যায় ।ত্রিশ দশকের জমিদার জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জির ব্যবহারের কথা শোনা যায়। সে সময়ে শতরঞ্জি রাজা-বাদশাহ্, বিত্ত্ববানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। বৃটিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এত বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এখানকার তৈরী শতরঞ্জি সমগ্র ভারতবর্ষ, বার্মা, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হত।
বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে ‘‘শতরঞ্জি বুনন’’ সবচেয়ে প্রাচীনতম। মজার ব্যাপার হলো, এ পণ্য উৎপাদনে কোন প্রকার যান্ত্রিক ব্যবহার নেই। কেবলমাত্র বাঁশ এবং রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো দিয়ে টানা প্রস্ত্তত করে প্রতিটি সুতা গননা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরী করা হয়। কোন জোড়া ছাড়া যে কোন মাপের শতরঞ্জি তৈরী করা যায়। এর সৌন্দর্য্য ও টেকসই উল্লেখ করার মত।
১৯৭৬ সালে সরকারীভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরীর একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু ব্যাপক বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় ধীরে ধীরে প্রকল্পটি মুখ থুবরে পড়ে। আশার কথা হলো যে, ১৯৯৪ সালে একটি বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা বিনা পয়সায় আরও উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে ঐ এলাকার মানুষদের শতরঞ্জি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। সেই থেকে আর থেমে নেই শতরঞ্জির উৎপাদন। এখন নিসবেতগঞ্জের প্রায় বাড়িতেই শোনা যায় শতরঞ্জি উৎপাদনের ঘটাং ঘটাং শব্দ । কালের বিবর্তনে বাংলার মসলিন শিল্প হারিয়ে গেলেও রংপুরের শতরঞ্জি স্বগর্বে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে এখনও।
বর্তমান সভ্যতায় কারুশিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে যা শতরঞ্জির জন্য অত্যন্ত শুভ । বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি উইরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানী হচ্ছে । এমনকি বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা । বর্তমানে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড নামক একটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরীর পাঁচটি কারখানা । বর্তমানে এসব কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছে ।এক পরিসংখ্যানে প্রাপ্ত তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানী বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানী হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে এই রংপুরের উৎপাদিত শতরঞ্জির মাধ্যমে। রংপুরের অজপাড়া গা নিসবেতগঞ্জ থেকে যে আজ শতরঞ্জি রপ্তানী হচ্ছে তা নয়। নতুন উদ্যমে বাড়ি বাড়ি তৈরী হচ্ছে শতরঞ্জি । নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি পল্লী যেন এক বিশাল কারুপণ্যে পরিণত হয়েছে । নিসবেতগঞ্জের অধিকাংশ বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা উঠানে টিনের ছাউনির নিচে নিপুন হাতে চলছে কারুকাজ খচিত শতরঞ্জি বোনার কাজ ।যেখানে পূর্বে হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই ইত্যাদি নামের নকশা সংবলিত শতরঞ্জি তৈরী হত সেখানে এখন আরও রং বেরং এর বাহারি নকশার শতরঞ্জি উৎপাদিত হচ্ছে ।
অবাধ বাণিজ্যে আর চরম প্রতিযোগিতার বাজারে রংপুরের ঐতিহ্য শতরঞ্জি যে বিশ্বজনীনতা লাভ করছে তা দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ঝার্ণধারার মত প্রবাহিত হোক রংপুরের শতরঞ্জি পল্লী চাঞ্চল্য।
সৌজন্যে: মোঃ আজহারম্নল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ, রংপুর।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস